স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অনস্তিত্বের সাপেক্ষে যুক্তি, লিখেছেন- অপার্থিব এবং রিসাস পার্ট- ২৭
আমি ইচ্ছার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না। শোপেনহাওয়ারের “মানুষের যা করতে ইচ্ছা হবে সেটা সে করতে পারে। কিন্তু সে কি ইচ্ছা করবে সেটা সে ইচ্ছা করতে পারে না” সেই উক্তিটি আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিত্য সাথী হয়ে আছে, অন্যের কর্মকান্ডের সাথে মানিয়ে চলার জন্য, যদি তা আমার জন্য পীড়াদায়কও হয়। স্বাধীন ইচ্ছার অনস্তিত্বের এই উপলব্ধি আমাকে আমার নিজের আর সঙ্গী সাথীদের বিচারবুদ্ধি বা ক্রিয়াকলাপকে খুব গাম্ভীর্যের সাথে নিয়ে পাছে আমার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি, তা থেকে আমাকে রক্ষা করে। – আইনস্টাইন, Mein Glaubensbekenntnis (আমার বিশ্বাস) , আগস্ট,১৯৩২ ]
১৮৩৯ সালে নরওয়েজীয় বিজ্ঞান সমিতির এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি
স্বাধীন চিন্তার উপর এক প্রবন্ধ সমিতির কাছে পেশ করেন, যাতে
তিনি লিখেছিলেনঃ
“You can do what you will, but in any given moment of your life
you can will only one definite thing and absolutely nothing other than that one
thing.”
রবী ঠাকুরের সপ্ততিতম জন্ম বার্ষিকীতে তাঁর সম্মানে ১৯৩১ সালে
রামানন্দ চ্যাটার্জি সম্পাদিত ও কোলকাতার Golden Book Committee কর্তৃক প্র্রকাশিত “The
Golden Book of Tagore” নামে এক দুর্লভ বইতে দেশ বিদেশের অনেক
জ্ঞানীগুণী লোক লেখা পাঠিয়েছিলেন। আইনস্টাইনও ঐ বইতে “About Free Will” (প্রসংগঃ স্বাধীন চিন্তা) নামে তাঁর একটা প্রবন্ধ পাঠান। এতে তিনি এক
জায়গায় লিখেছিলেনঃ
“যদি পৃথিবীর চারিদিকে সদা ঘূর্ণায়মান চাঁদকে সহসা
আত্মসচেতনতাপ অর্পণ করা যেত তাহলে চাঁদ হয়ত নিশ্চিত ভাবত যে সে তার নিজের ইচ্ছায়ই
পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক তেমনভাবেই উন্নততর বুদ্ধি আর অন্তর্দৃষ্টি
সম্পন্ন কোন সত্তা যদি মানুষ ও তার কর্মকে পর্যবেক্ষণ করত তাহলে নিজের ইচ্ছায় কাজ
করছে বলে মানুষের যে অধ্যাস সেটা ভেবে নিশ্চয় মুচকি হাসত।”
স্বামী বিবেকানন্দ যদিও কিছু অবৈজ্ঞানিক কথা
বলেছিলেন, কিন্তু স্বাধীন চিন্তার বিষয়ে তাঁর নীচের বক্তব্য
বিজ্ঞানসমঞ্জস বা যুক্তিপূর্ণ বলা যায়ঃ
‘’Therefore we see at once that there cannot be any such thing as
free-will; the very words are a contradiction, because will is what we know,
and everything that we know is within our universe, and everything within our
universe is moulded by conditions of time, space and causality. … To acquire
freedom we have to get beyond the limitations of this universe; it cannot be
found here.’’
[“অতএব সহসাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে স্বাধীন
ইচ্ছা বলে কিছু থাকতে পারে না, এরশব্দগুলোই স্ববিরোধিতাপূর্ণ,কারণ ইচ্ছা হল যা আমরা জানি, আর আমরা যা কিছুই জানি তা আমাদের মহাবিশ্বের
ভেতরেই বিরাজ করে, আর মহাবিশ্বে বিরাজমান সব কিছুই স্থান,কাল ওকার্যকারণের দশার দ্বারা নির্মিত …স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের মহাবিশ্বের
সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যা এখানে পাওয়া যাবে না”) – স্বামী বিবেকানন্দ (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র ] [
তথ্যসুত্রঃ মুক্তমনা, অপার্থিব]
আমাদের মস্তিষ্কের একটি ইলেক্ট্রিক্যাল পালসেশন প্রতি ঘন্টায় ২৫০ মাইল বেগে ভ্রমণ করে, কোনো ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার পেছনের কারণটি এত দ্রুত গতিতে সৃষ্টি হয় যে আমাদের মস্তিষ্ক সেটা অনুভবই করতে পারেনা, তার মানে আমরা ইচ্ছা করার পূর্বেই আমাদের মস্তিষ্কে ইচ্ছাশক্তি প্রস্তুত হয়ে যায়।বিজ্ঞানীরা কন্ডিশন রিফ্লেক্সের উপর গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের মস্তিষ্কের ইচ্ছাশক্তি তার সচেতনতার প্রায় ৩০ সেকেন্ড পূর্বেই তৈরি হতে পারে।তার মানে মাইন্ড এবং বডি নিজে নিজেই কাজ করে।আইনস্টাইন যেমনটি বলেছিলেন, আমরা কেউই ইচ্ছে করে ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারিনা!আইনস্টাইনের মতে, মানুষের কোনো ফ্রি ইউল নেই, সৌরজগতের গ্রহগুলি যারা মহাকর্ষের নিয়মে সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাদেরকে যদি এক পিকোসেকেন্ডের জন্যেও চেতনা প্রদান করা হতো, তবে তারা মনে করতো তারা নিজে নিজেই সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, তারা মনে করতো না যে তাদের আবর্তনে মহাকর্ষের কোনো ভূমিকাই আছে ! মানুষ সচেতন প্রাণী আর সেজন্যেই তারা নিজেদের স্বাধীন মনে করছে , স্বাধীনতা একটি ইলুশন।বৈদ্যুতিক শক খেলে মানুষ নিজের অজান্তেই দোড়াতে থাকে, শরীরে সুইয়ের খোঁচা লাগলে তাৎক্ষণিক আমাদের হাত আক্রান্ত স্থানে জাম্পিং করে।সানফ্রান্সিসকো মাউন্ট জায়ান্ট ইউনিভার্সিটির নিউরো-সাইকোলজিস্ট ব্যানজামিন লিবেট এবং বার্টাম ফিনেস্টাইন একবার একটি এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করেন যা সম্পূর্ণ সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।তারা একটি স্পর্শের ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল মস্তিষ্কে পৌঁছাতে কতক্ষণ সময় প্রয়োজন হয় তা নির্ণয় করেন এবং পেশেন্টদের বলেন সিগনালটি তাদের মস্তিষ্কে সেন্ড হওয়ার সাথেসাথে একটি বোতামে প্রেস করতে।বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন সিগনালটি মস্তিষ্কে যেতে সময় প্রয়োজন হয় ০.০০০১ সেকেন্ড অথচ তারা বোতামটি প্রেস করতে সময় অপচয় করছিলো ০.১ সেকেন্ড।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বোতামটি সচেতনভাবে প্রেস করা তাদের পক্ষে ০.৫ সেকেন্ডেও সম্ভব ছিলোনা যা তারা করেছিলো।তার মানে তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বেই তাদের সাব-কনসাস মাইন্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।ইভেন্ট সম্পর্কে অগ্রিম সতর্কতা তাদের গতিকে ধীর করে দেয়।তাদের সাব-কনসাস মাইন্ডই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তারা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে এবং যেকোনোভাবে তাদের মস্তিষ্ক একটি কমফোর্ট ডিলুশন তৈরি করে রেখেছিলো যে তারাই একশন কন্ট্রোল করছে!
আমারা কী আমাদের দেহের ৩৭ ট্রিলিয়ন সেল অথবা ৭ অক্টিলিওন এটমকে নিজের ইচ্ছায় পরিচালনা করছি? আমাদের দেহের পরমাণুর কক্ষপথে আবর্তিত ইলেক্ট্রনগুলির ভবিষ্যত গতিবিধি কী আমরাই সচেতনভাবে নির্ধারণ করছি যদি তারা ফিজিক্সের সুত্র
দ্বারাই পরিচালিত হয়?বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আমরা আমাদের হাতের পেশি মুভ করার কমপক্ষে এক মিনিট পূর্বেই আমাদের মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সূতরাং প্রত্যেকটি ইভেন্ট আমাদের মস্তিষ্কে অনেক পুর্বে সংঘঠিত হয়, আমাদের ডিসিশনের বহু পূর্বেই।
কিন্তু স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে কেনো আমি বিভ্রম প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, কেনো একে ভীত্তিহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করছি?হ্যা, কারণ আছে।কারণ হলো ঈশ্বর এবং তার ধর্মগ্রন্থ।ধর্মগ্রন্থগুলিতে বলা হয় মানুষকে তার পাপের শাস্তি প্রদান করা হবে কারণ তার পাপের পেছনে তার ইচ্ছাশক্তি বিজড়িত থাকে, মানুষ নিজের ইচ্ছায় পাপ করে কারণ কর্মের ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।কিন্তু আসলেই কী স্বাধীন?ইসলাম ধর্ম আমাদের বলে, মানুষকে সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বা লিমিটেট ফ্রি ইউল এন্ড চয়েজ দিয়ে পাঠানো হয়েছে, সম্ভবানা থেকে বাস্তবতা নির্বাচনে সে সম্পূর্ণ স্বাধীণ। এমনকি দার্শনিক সাত্রেও প্রায় একই কথা বলেছিলেন, তার মতে মানুষ মুক্তি হওয়ার সাজাপ্রাপ্ত।মানুষ তার কর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত, তার জীবনে প্রকৃতি প্রদত্ত কোনো মিনিং নেই, সে তার জীবনের জন্যে যে মিনিং নির্ধারণ করবে সেটাই তার জীবনের মিনিং, অতএব মানুষ তার কর্মের দায়বদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেনা, তার কর্মের দায়বদ্ধতা তার নিজের উপরই আপতিত হয়।অথচ লিবেট এবং ফিনেস্টাইনের এক্সপেরিমেন্ট থেকে আমরা দেখেছি মানুষের স্বাধীনতা তার মস্তিষ্কের সচেতনতা থেকে সৃষ্ট একটি কমপোর্ট ডিলুশন, বস্তুত আমাদের ব্রেন একটি ইভেন্ট সম্পর্কে কয়েক মিনিট পূর্ব থেকেই অবগত থাকে!যদি মানুষের ফ্রি উইল একটি ইলুশনই হয় তবে ঈশ্বর পাপের ডেফিনিশন কিভাবে নির্ধারণ করবেন?কিভাবে তিনি অন্যায়কারীকে শাস্তিপ্রদান করবেন যদি তার স্বাধীন কোনো অন্যায়ই না থাকে?স্টিফেন হকিংস বলেছিলেন, পুর্বনির্ধারণবাদ এবং ব্যাক্তি স্বাধীনতা একে অপরের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে।তিনি তার গ্রাউন্ড ব্রেকিং গ্রন্থ দ্যা গ্রেন্ড ডিজাইনে লিখেছিলেন, ঈশ্বর যদি মহাবিশ্বের নিয়তিকে নির্ধারণ করেই রাখেন, তবে আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় তার সেই মহাজাগতিক পোগ্রামিংকে অতিক্রম করা, আর এ মুহূর্তে যদি আমার মৃত্যু রোড এক্সিডেন্টেই পোগ্রামড হয়ে থাকে তবে আমি কেনো রাস্তা ক্রস করার সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি!যাইহোক আপাত দৃষ্টিতে আমরা ব্যাক্তি স্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিনা। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স এবং গ্রেভিটেশনাল ফোর্স একে অপরের সাথে রিলেটিভ , এদের কোন ইন্ডিপেন্ডেট অস্তিত্ব নেই ঠিক একইভাবে আমাদের মাঝেও স্বাধীন কোনো ইচ্ছাশক্তি নেই!আর যদি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্বই না থাকে তবে ঈশ্বর আমাদের বিচার করতে পারেন না, বিচার করা সম্ভব নয়, যে অন্যায়ের পেছনে আমার সচেতন মনের কোনো অবদানই নেই তা কখনোই অন্যায় হতে পারেনা, যদিও আমি নিজেকে অপরাধী মনে করি!প্রশ্ন জাগে, তার মানে, একজন খুনী অপরাধী নয়?একজন ধর্ষক অপরাধী নয়?তারা কোনো অপরাধ করেনি?যদি সবকিছু মন শরীর এবং মহাবিশ্বে এমনিই এমনিই ঘটে থাকে তবে আইনের প্রয়োজনীয়তা কী?কী হবে ন্যায়শাস্র দিয়ে?ধর্ম কেনো?আর কী হবে সে সকল মানুষের সাথে যারা চরমভাবে নির্যাতিত, যাদের শক্তি নেই, যারা দূর্বল?কী হবে তাদের সাথে যারা সারাজীবন শোষিত হচ্ছে, যাদের প্রতিবাদের শক্তি নেই, নিরবে নিবৃত্তে যারা ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে সকল অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছে!স্বাধীন
ইচ্ছাশক্তির বিশ্লেষণ সংক্রান্ত একটি ভাইব্রেটিক প্রবন্ধ যা মুক্তমনাতে অপার্থিব
প্রকাশ করেছিলেন সেটি আমি আপনাদের গবেষণার
স্বার্থে উপস্থাপন করলামঃ
জীববিজ্ঞানী অ্যান্টনী ক্যাশমোর আমেরিকার Proceedings of the
National Academy of Sciences উদ্বোধনী প্রবন্ধ “The Lucretian
swerve: the biological basis of human behavior and the criminal justice system.” এ স্বাধীন ইচ্ছা যে একটি অধ্যাস সেটা বলেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি স্বাধীন ইচ্ছা ভিত্তিক প্রচলিত আইন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিমত দিয়ে
তার সংস্কারের পরামর্শও দেন।
স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব/অনস্তিত্বের প্রশ্নটা এতই গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় বলেই
আমেরিকার প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান “জন টেম্পলটন ফাউন্ডেশন”, যার মূল লক্ষ্য হল বিজ্ঞানের সাথে আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় সাধন,তারা ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ড: অ্যালফ্রেড মেলের নেতৃত্বে স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্বের
অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও দার্শনিক অনুসন্ধানের জন্য তিন বছর মেয়াদের (২০১৩ সালে সমাপনীয়) একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের জন্য চুয়াল্লিশ লক্ষ ডলারের অনুদানও
বরাদ্দ করা হয়েছে!
জীববিজ্ঞানী অ্যান্টনী
ক্যাশমোর স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসকে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনা করেছেনঃ
“A belief in free will is akin to religious beliefs. .. –
Neither religious beliefs, nor a belief in free will, comply with the laws of
the physical world” (স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস ধর্মীয় বিশ্বাসের
সমতুল্য। দুটোর কোনটাই ভৌত জগতের বিধিসমূহকে মেনে চলে না)
মুক্তমনায় আপার্থিব বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরেছেন, প্রথমপুরুষের
দৃষ্টিতে মানুষ কোটী কোটি কোষের সমন্বয়ে গঠিত একটি তন্ত্র, যা
পদার্থেবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে। কোটি কোটি স্নায়ুকোষ বিজ্ঞানের নিয়মে কাজ করে “আমির” অধ্যাস সৃষ্টি করে। মানুষের দেহ ও মস্তিষ্ক কে
সূক্ষ্ণ ভাবে বিশ্লেষণ করলে অণু পরমাণু দ্বারা গঠিত কোষ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে
না। বিবর্তনের ক্রিয়ায় সৃষ্ট মস্তিষ্কের কর্টেক্স এ কোটি কোটি স্নায়ুকোষগুলির
সম্মিলিত ক্রিয়ার ও বিশেষ বিন্যাসের ফলে উদ্ভূত বিকাশমান ধর্ম (Emergent
properties) এই আমিত্ব, স্বাধীন ইচ্ছা
ইত্যাদির অনুভূতি বা অধ্যাস সৃষ্টি করে। আধুনিক বিজ্ঞান স্বাধীন ইচ্ছা/আত্মার
কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছে বলা যায়। আধুনিক বিজ্ঞান (বিশেষ করে স্নায়ুবিজ্ঞান)
এর যুগান্তকারী অভিজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হয়ে “Bonfire of the Vanities” খ্যাত টম উল্ফের মত একজন সাহিত্যিক ও লেখকও হয়ত অভিভূত হয়েই “দুঃখিত, আপনার
আত্মা এইমাত্র মৃত্যু বরণ করেছে” নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন ১৯৯৬ সালে,যা থেকে একটা উদ্ধৃতি নীচে তুলে দিলামঃ
“Eventually, as
brain imaging is refined, the picture may become as clear and complete as those
see-through exhibitions, at auto shows, of the inner workings of the internal
combustion engine. At that point it may become obvious to everyone that all we
are looking at is a piece of machinery, an analog chemical computer, that
processes information from the environment. “All,” since you can look and look
and you will not find any ghostly self inside, or any mind, or any soul.”
( সারমর্মঃ আরো পরে যখন ব্রেইন ইমেজিং আরো
সূক্ষ্ণ ভাবে করা যাবে, তখন চিত্রটা পরিস্কার হয়ে আসবে, ঠিক যেমন প্রদর্শনীর সেই স্বচ্ছ গাড়ীগুলো, যার ভেতরের অন্তর্দাহ ইঞ্জিন স্পষ্টই দেখা যায় । সেই সময় এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে আমরা
কেবল একটা যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছি, একটা অ্যানালগ রাসায়নিক কম্পিউটার যা তার
চারিপাশ থেকে তথ্য উপাত্তনিয়ে প্রক্রিয়া করছে। কেবল বলছি এজন্য যে যতই দেখনা কেন, এর ভেতরে আত্মা, অহম্, মন কিছুই খুঁজে পাবে না)
নোবেল বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর বই “আশ্চর্যজনক
প্রকল্পঃ আত্মার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান” (The Astonishing Hypothesis: The
Scientific Search for Soul ) বইতে লিখেছেনঃ
‘You,’ your joys and your sorrows, your memories and your
ambitions, your sense of personal identity and free will, are in fact no more
than the behavior of a vast assembly of nerve cells and their associated
molecules. Who you are is nothing but a pack of neurons … although we appear to
have free will, in fact, our choices have already been predetermined for us and
we cannot change that.
(তুমি, তোমার সুখ দুঃখ,
তোমার স্মৃতি ও আকাংখা,তোমার নিজস্ব সত্তার
অনুভূতি ও স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাস, এ সবই বহূসংখ্যক
স্নায়ূকোষ ও তাদের সংশ্লিষ্ট অণুসমূহের সমষ্টিগত আচরণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তুমি এক
রাশ স্নায়ূকোষ বৈ কিছুই নও – যদিও আমাদের স্বাধীন চিন্তা আছে
বলে মনে হয়, আসলে আমাদের ইচ্ছা আগে ভাগেই নির্ধারিত হয়ে আছে
যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি না)
, (http://en.wikisource.org/wiki/The_Complete_Works_of_Swami_Vivekananda/Volume_1/Karma-Yoga/Freedom))
একই কথা বলেছেন হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড: ড্যানিয়েল ওয়েগ্নার (Daniel M. Wegner)। তিনি বেশ জোরাল ভাবেই স্বধীন ইচ্ছার ধারণাকে অপোহ করেছেন। তিনি
তাঁর বই “স্বাধীন ইচ্ছার অধ্যাস”(The Illusion of Free Will) এ
লিখেছেন স্বাধীন ইচ্ছা হল একটা অনুভূতি, আমাদের কর্মের উপর
আমাদের নিয়ন্ত্রনের একটা অনুভূতি। আমরা যখন মন করি যে এখন আমি উঠব, এবং তার কিছুক্ষণ পর যখন উঠলাম, তখন আমরা এই উঠবার
অনুভূতিকে কৃতিত্ব দেই উঠবার কারণ হিসেবে। কিন্তু এটা সুবিদিত যে কারণ আর অনুবন্ধ
এক জিনিষ নয় (correlation is not causation)। ড: ওয়েগ্নার সম্মোহন, উইজা বোর্ড, ডাউজিং (Dousing)
ইত্যাদির উদাহরণ টেনে যুক্তি দেন যে স্বধীন চিন্তা প্রকৃত অর্থে
থাকলে এরকম মনের উপর সচেতন নিয়ন্ত্রণ হারানো অর্থহীন হয়ে পড়ে। এছাড়া তিনি
বেঞ্জামিন লিবেটের বিখ্যাত পরীক্ষার উল্লেখ করেন যাতে প্রমাণিত হয় যে আমাদের
ইচ্ছানুযায়ী কোন ক্রিয়া করার সচেতন উপলব্ধির আগেই ক্রিয়াটি কৃত হয়। এই প্রসঙ্গে
উল্লেখ করে রাখি যে ২০০৮ সালের এপ্রিলে জার্মানীর ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউটের
বিজ্ঞানীরা লিবেটের ১৯৮৩ সালের মূল পরীক্ষাকে (যা এর আগে জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী
হ্যান্য্ কর্নহুবার এর এক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে করা) আধুনিকীকরণ করে পুনর্বার
সম্পন্ন করার পর যে ফল পেয়েছেন তা লিবেটের পরীক্ষার ফলাফলকে আবারও সমর্থন করে।
অতিসম্প্রতি আরেক স্নায়ুবিজ্ঞানী স্যাম হ্যারিস তাঁর বিতর্ক
সৃষ্টিকারী “The Moral Landscape: How ScienceCan Determine Human Values” বই এর “The Illusion of Free Will” (স্বাধীন
ইচ্ছারঅধ্যাস) অধ্যায়ে (পৃঃ ১০২-১১২) বলেছেনঃ “no account of causality
leaves room for free will.” “Our belief in free will arises from our
moment-to-moment ignorance of specific prior causes.”
এই স্বাধীন ইচ্ছার অধ্যাস মানুষের এতই
মজ্জাগত যে এটা যে শুধু বিশ্বাসীদের মধ্যেই আছে তা নয়, অনেক উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এই অধ্যাস বর্তমান। তাঁরা
স্বাধীন ইচ্ছাকে মহিমান্বিত করা মানবতাবাদের অংগ হিসেবেদেখেন বা স্বাধীন ইচ্ছার
কারণেই মানুষ যে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা বা শ্রেয় এটা প্রমাণ করার জন্যই হয়ত এটা
ভাবেন।এটা তাদের চিন্তায় আসে না যে বিজ্ঞানের সত্য মানবতার ধার ধারে না। তাদের
একটা বাধা বুলি হল, স্বাধীন ইচ্ছা নেই,মানুষের সব কাজই কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত এরকম কথা বা ধারণা খুব যান্ত্রিক (Mechanistic), মানুষকে রোবট বানানোর সামিল। ধর্মবাদী সহ ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদেরও এই
অধ্যাস ও মানসিকতার সমালোচনা করেছেন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন,মনস্তত্ব ও মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়েন ফ্ল্যানাগান তাঁর “The Problem of the
Soul: Two Visions of the Mind and How to Reconcile Them” বইতে। তিনি ডেকার্টেকের দ্বৈতবাদকেই এই অধ্যাসের জন্য দায়ী করেন।
স্বাধীন ইচ্ছায় মজ্জাগত বিশ্বাস পরিত্যাগে
অনিচ্ছুক অনেকেই তাদের বিশ্বাসের সমর্থনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা (Uncertainty বা অক্রম (Randomness/Stochasticity) এর ধারণাকে প্রয়োগ
করে স্বাধীন ইচ্ছাকে জীইয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কোয়ান্টামবলবিদ্যা সম্পর্কে সম্যক
জ্ঞান বা যুক্তিজ্ঞানের অভাবের ফলেই তাদের এই চেষ্টা। প্রথমত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা
প্রকৃতির এক নিয়মেরই ব্যক্তীকরন। প্রকৃতির সবকিছুই যদি অনিশ্চিত বা অক্রম হত তাহলে
প্রকৃতিতে কোন নিয়মই থাকার কথা নয়, কোয়ান্টামই হোক বা ধ্রূপদী বলবিদ্যাই হোক।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রতিটি আণুবীক্ষণিক ঘটনার সম্ভাব্যতা একটি প্রমাদহীন সংখ্যা দিয়ে
ভবিষ্যৎবাণী করে। যা পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা যায়। প্রকৃতি আসলেই অনিশ্চিত, অক্রম বা নিয়মহীন হলে এটা সম্ভব হত না। দ্বিতীয়ত স্বাধীন ইচ্ছার সাথে অক্রম এর
কি সম্পর্ক?
স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস মানে বিশ্বাস করা যে ইচ্ছার
নিয়ন্ত্রক হল আত্মা বা অহম্ (Self) । আত্মা বা অহম্ তো
অক্রম,
অনিশ্চিত বা কার্যকারণহীন হতে পারে না, হলে তো স্বাধীন ইচ্ছার আর কোন মানেই থাকে না। যারা আত্মার পরিবর্তে মস্তিষ্কের
দ্বারা সৃষ্ট স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী তাঁরাও ভুলে যান যে মস্তিষ্ক একটি বৃহৎ
তন্ত্র (Macroscopic Object) যেখানে কোয়ান্টাম
প্রভাব অবর্তমান। আর মস্তিষ্কের কর্মকান্ড সম্পূর্ণভাবে ভৌত কার্যকারণ মেনে চলে।
কোটি কোটি কোয়ান্টাম আণুবীক্ষণিক কণাসমূহ একসঙ্গে সমন্বিততভাবে কাজ করলে কণাসমষ্টি
দ্বারা গঠিত কোন বৃহৎ তন্ত্রে কোয়ান্টাম ক্রিয়া উবে যায়। এটাকে কোয়ানন্টাম
ডিকোহারেন্স(Decoherence) বলে। কাজেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা টেনে এনে
স্বাধীন ইচ্ছাকে বাচানোর চেষ্টা নিষ্ফল।
স্বাধীন ইচ্ছার অনস্তিত্বের কথা উঠলে
অবশ্যম্ভাবীভাবে নিয়তির প্রশ্ন উঠে আসে। স্বাধীন ইচ্ছা যদি নাই থাকে তাহলে সবই কি
পূর্বনির্ধারিত হতে হয় না?,কারণ স্বাধীন ইচ্ছা ছাড়া তো ভাগ্য পরিবর্তন
করা যায় না,
স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসীরা একথা বলবেন। কিন্তু তাঁরা
কার্যকারণের অর্থ বুঝতে ভুল করছেন। ভাগ্য পরিবর্তন করার কথার মধ্যেই তো একটা
ব্যাকরণগত ভুল রয়েছে। যা ভবিষ্যতে ঘটবে সেটাই তো ভাগ্য। পরিবর্তন করার লক্ষ্যে
মানুষ বর্তমানে যা কিছু করবে বা চেষ্টা করবে তার সবই ঐ ভাগ্যের হিসাবের মধ্যেই ধরা
আছে। নিয়তি তো একটাই । সম্ভাবনা অনেকগুলিই আছে ঠিকই কিন্তু নিয়তির মানে হল ভৌত
কার্যকারণের ফলে বহূ সম্ভাবনার মধ্যে একটা নির্ধারিত হয়ে যাওয়া। একটা উদাহরণ দিয়ে
বোঝান যাক। সবাই জানে যে লেখাপড়া মন দিয়ে করলে পরীক্ষায় ভাল ফল হয়, পরিণামে ভাল চাকুরীবা পেশা পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরেও অনেকে লেখাপড়ায় ঢিলেমী
দেয়। তারা কি ভাক চাকুরী বা পেশা মনে মনে চায় না। কিন্তু তার জন্যএই মূল্য দিতে
তারা প্রস্তুত নয়। রক্ত চাপের রুগী জানে যে লবন খাওয়া খারাপ, ডায়াবীটিসের রূগী জানে চিনি খাওয়া নিষেধ, তারপরও অনেক রূগী বিধি নিষেধ না মেনে
মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে আসে। ধূমপান করলে ফুস্ফুসের ক্যান্সার হতে পারে জেনেও অনেকে
ধূমপানে লিপ্ত হয়। বলা হবে নিয়ম মানা না মানা তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্বাধীন ইচ্ছার
দ্বারা সে নিজেই তার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে
কে বিধি নিষেধ মানল আর কে মানলো না (বা মেনে চলতে চাইল বা চাইলি না) সেটা তাদের মধ্য একটা মৌলিক স্বভাবগত পার্থ্যক্যের জন্য হচ্ছে, যার মূলে আছে তাদের বংশাণুগত বা/এবং পরিবেশগত পার্থক্য। এর কোনটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে নয় ।
কাজেই ইচ্ছাজনিত সিদ্ধান্ত বা কাজ যদি বংশাণু বা পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়
তাহলে ইচ্ছাটা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয় (আইনস্টাইনের সেই শোপেনহাওয়ারেরউদ্ধৃতি “মানুষ যা চাইবে সেটা সেটা অবশ্যই করতে পারে। কিন্তু কি চাইবে সেটা সে চাইতে
পারে না”
এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়) ।
একটা মজার ব্যাপার লক্ষণীয় যে স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসীদের অনেকের
জীবনে এমন ঘটনাও ঘটে যখন কোন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে সৌভাগ্যের দ্বার খুলে গেল, বা
জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসল, তখন তারাই অতীতের দিকে তাকিয়ে
বলে এরকম দুর্ভোগ তার কপালে লেখা ছিল বলেই ঘটেছে, বা এরকম
সৌভাগ্য কোন দৈব কারণ ছাড়া ঘটতে পারে না। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় মনে হয় এটা
তার নিজস্ব স্বাধীন চিন্তা জনিত, কিন্তু সিদ্ধান্তের ফলাফলের
উপর নির্ভর করে পরে সেটা নিয়তির ক্রিয়া বলে মনে হয়।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি বা শুনি সেটা হল
ভাগ্যে বিশ্বাস করে না এমন অনেকেও কোন বিমান দুর্ঘটনার খবরশুনে, যে
ফ্লাইটে তার ওড়ার কথা ছিল কিন্তু কোন কারণে তার ওড়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হল,
বলে “ভাগ্যিস আমি ঐ ফ্লাইটে ছিলাম না”,থাকলে আমি আজ বেচে থাকতাম না। এর দ্বারা সে এটাই বলতে চাইছে যে সে ঐ
ফ্লাইটে থাকলেও বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হত।কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে এই চিন্তার
কিছু অসংগতি ধরা পড়ে। ধরি ব্যক্তিটির নাম ‘ক’ । চারটি সম্ভাবনা দেখা যায়ঃ
১। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
২। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল না এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
৩। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে না।
৪। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল না এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে না।
২। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল না এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
৩। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে না।
৪। ‘ক’ ফ্লাইটে ছিল না এবং ফ্লাইটটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে না।
আমাদের উদাহরণে ২ নং সম্ভাবনাটি ঘটে। ‘ক’ এর উক্তির অর্থ অনুযায়ী সে এটাই বলতে চাইছে যে (২) নং সম্ভাবনা না ঘটলে(১) নং সম্ভাবনাই ঘটবে,
(৩) নং
সম্ভাবনা নয়। কিন্তু এরকম মনে করার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। (২) নং সম্ভাবনা ঘটার পূর্বে অসীম সঙ্খ্যক কার্যকারণ প্রতি মুহূর্তে কাজ করে করে একটা কার্যকারণের শৃংখল (Infinite chain of causality) তৈরী করে যার অনিবার্য পরিণতিতে (২) নং সম্ভাবনা ঘটে। (২) নং সম্ভাবনা না ঘটনার অর্থ হল (২) ঘটার জন্য পূর্বশর্তের অসীম কার্যকারণের শৃংখল তৈরী হয় নি, অন্য কোন অসীম কার্যকারণের শৃংখল তৈরী হয়েছিল। কিন্তু এই ভিন্ন কার্যকারণের শৃংখল যে (১) সম্ভাবনাকেই ঘটাত,
(৩) কে
নয় এটা
কি করে
বলা যায়?। (১) ঘটার পূর্বশর্ত তো “(২) না ঘটা” নয়। (১) এর পূর্বশর্ত তো আমাদের জানারই কথা নয়। কোনটারই পূর্বশর্ত আমাদের জানা সম্ভব নয়, কারণ তা এক অসীম শৃংখল । অবশ্য যে সম্ভাবনাটা ঘটল তার পরই আমরা বলতে পারব যে সেটি ঘটার পূর্বশর্ত মিটেছিল বলেই সেটা ঘটেছে । আর এমনটি তো নয় যে (২) এবং (১) এর মধ্যকার তফাৎ শুধুই একটি, অর্থাৎ ‘ক’ ফ্লাইট এ ছিল। অন্য সব ঘটনা একই ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে অনেক অণুঘটনা (বা ছোট ছোট ঘটনা) জড়িয়ে থাকে যার ফলে দু ঘটনার অসীম কার্যকারণের শৃংখল ভিন্ন হতে পারে। যেমন ‘ক’ ফ্লাইটে থাকলে বিমানের যাত্রী সঙ্খ্যা ভিন্ন হত, ভর বন্টন অন্যরকম হত, তা ছাড়া ‘ক’ যে কারণে ফ্লাইটে উঠল সেই কারণটা বিমানের যাত্রার উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে। এরকম অনেক কিছু। আমরা “Butterfly Effect” এর কথা জানি। জটিলতার ক্ষেত্রে খুব ক্ষুদ্র কোন ক্রিয়া বিরাট আকারে ব্যক্ত হতে পারে অন্য কোন ক্রিয়ার মাধ্যমে। কাজেই (২) এবং (১) এর মধ্যে ‘ক’ ফ্লাইটে এ ছিল, এটা ছাড়াও অন্য যে কোন ক্ষুদ্র ঘটনার তফাৎ থাকলে তার কারণেও (১) না ঘটে (৩) ঘটতে পারত।
অন্য ভাবেও দেখা যাক বিষয়টা। “২” না ঘটলে “১” ঘটত (বা (৩) ঘটত
না) এই ধরণের উক্তির দ্বারা বোঝান হয় যে (১) এর কার্যকারণহল (২) না ঘটা। এই ধরণের
কার্যকারণের রূপকে “প্রতিবাস্তব কার্যকারণের শর্ত বলা হয় “(Counterfactual
Causality/conditional) ।কিন্তু এই কার্যকারণ আরোপ যে উপরের
ক্ষেত্রে ভুল সেটা উল্লেখ করেছি। যাঁরা সমান্তরাল বিশ্বের কথা জানেন তাঁরা উপরোক্ত
চারটি সম্ভাবনাকে সমান্তরাল বিশ্বের চারটি ভিন্ন ইতিহাস হিসেবে দেখতে পারেন (অবশ্য
এই চারটির আরও অনেক ক্ষুদ্র অণুঘটনার তফাৎ আছে, কাজেই প্রকৃত
ভিন্নসম্ভাবনার সংখ্যা অসীম) । সব গুলোরই অস্তিত্ব আছে। কিন্তু একটার সাথে আরেকটার
কোন কার্যকারণগত সম্পর্ক নেই। কার্যকারণের সঠিকতা যাঁচাইনা করে এই ধরণের উক্তি
বলাকে প্রতিবাস্তব চিন্তা (Counterfactual Thinking) বলা হয়।
প্রতিবাস্তব চিন্তা সঠিক হতে পারে, বা ভুলও হতেপারে, যেমন উপরের উদাহরণে দেখলাম এটা বলা বা ইঙ্গিত করা যে (২) না ঘটলে (১) ঘটত,
যেখানে (১) এর কারণ (২) না ঘটা নয়। ইতিহাসবেত্তারা ঐতিহাসিক ঘটনা
নিয়ে প্রায়ই প্রতিবাস্তব চিন্তা করেন। এটাকে প্রতিবাস্তব ইতিহাস (Counterfactual
history) বলে । কোন এক বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা না ঘটলে ইতিহাস কোনদিকে
যেত সেটা অনুমান করাই প্রতিবাস্তব ইতিহাসের কাজ।
এবার আসি নিয়তির ব্যাপারে বিজ্ঞানের কি বক্তব্য সেটা নিয়ে। এটা
শুনে অনেকে হয়ত আশ্চর্যান্বিত হতে পারেন যে অনেক বিজ্ঞানীই নিয়তিতে বিশ্বাস করেন।
নিরেট মহাবিশ্বের তত্ত্ব বা দৃষ্টিকোন(Block Universe View) সে কথাই বলে। এই দৃষ্টিতে অতীত,
বর্তমান অ ভবিষ্যতের মধ্যকার সীমারেখাকে কৃত্রিম বিবেচনা করা হয়।
মহাবিশ্বের যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবে সবই একই সাথে
বিদ্যমান বলে মনে করা হয়।ত্রিমাত্রিক স্থানে কোন রেখা যেমন ‘ক’
বিন্দু থেকে ‘খ’ বিন্দু
পর্যন্ত বিস্তৃত হলে আমরা বলিনা রেখাটা ‘ক’ থেকে ‘খ’ তে গেছে। ঠিক তেমনি
জগতের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সব ঘটনাই চতুর্মাত্রিক
স্থানে বসান একটা ঘটনা রেখা। এটা বলা যায় না যে সময় অতীত থেকে ভবিষ্যৎএর দিকে তা
প্রবাহিত হচ্ছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব ঘটনা সমূহ
চতুর্মাত্রিক এক জালিকায় (Matrix) এ গাঁথান আছে। আমরা শুধু
আমাদের অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে সচেতন। ঠিক যেমন সমুদ্র বা নদীর ওপার না দেখতে
পেলেও আমরা জানি যে ওপার আছে, ঠিক তেমনই ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে
বা জানতে না পারলেও (গণৎকার বা দৈবজ্ঞ ব্যতীত) ভবিষ্যৎ যে নেই সেটা বলা যায় না।
ব্লক মহাবিশ্বের ধারণার প্রথম প্রবক্তা ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী মিনকাউস্কি (Minkowski)। আইনস্টাইন ও এই ব্লক মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর সারা
জীবনের বন্ধু মিশেল বেসোর মৃত্যুতে বেসোর পরিবারকে লেখা এক শোক বার্তায় বলেছিলেনঃ
“Now he has departed from this strange world a little ahead of
me. That means nothing. People like us, who believe in physics, know that the
distinction between past, present, and future is only a stubbornly persistent
illusion.”
এখন সে এই রহস্যময় জগত থেকে বিদায় নিয়েছে, আমার
একটু আগেই। এতে কিছুই আসে যায় না। আমাদের মত মানুষ, যারা
পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বাস করে, জানে যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্য পার্থক্যটা একটা একগুঁয়েমীভাবে লেগে থাকা অধ্যাস
মাত্র]
পদার্থবিজ্ঞানী ও পিবিএস চ্যানেলের
“The Elegant Universe” সিরিজের
উপস্থাপক ব্রায়ান গ্রীন ব্লক মহাবিশ্বে বিশ্বাস করেন। তাঁর বই “The Fabric
of the Universe” এই ব্লক মহাবিশ্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বর্তমানের
ধারণাটা যে একটা অধ্যাস, বা পুরো সময়ের ধারণাটাই অধ্যাস,
“বিশেষ এখন” বলে যে কিছু নেই সেটা নিয়ে পিবিএস
এর রেডিও ল্যাব এক বিশেষ রেডিও শো’র (No Special Now)
আয়োজন করে যেখানে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রীন, মিচিও কাকু, লিসা রেন্ডল,
স্নায়ূবিজ্ঞানী
রামাচন্দ্রন এক মনো-গ্রাহী আলোচনয় অংশ নেন। এতে স্বাধীন চিন্তা নিয়েও আলোচনা করা
হয়েছে।
তথসুত্র-মুক্তমনা, অপার্থিব, Klemm,
W. (2010). Free will debates: Simple experiments are not so simple Advances
in Cognitive Psychology, 6 (-1), 47-65 DOI: 10.2478/v10053-008-0076-2,
Adamatzky, A. (2012). Slime mould computes planar shapes.
Int. J. Bio-Inspired Comput. 4, 149–154.
Aharonov, Y., and Vaidman, L. (1990).
Properties of a quantum system during the time interval between two
measurements. Phys. Rev. A 41, 11.
Amassian, V. E., Somasunderinn, M.,
Rothswell, J. C., Crocco, J. B., Macabee, P. J., and Day, B. L. (1991).
Paresthesias are elicited by single pulse magnetic coil stimulation of motor
cortex in susceptible humans. Brain 114, 2505–2520.
Aspect, A., Grangier, P., and Roger, G.
(1982). Experimental realization of Einstein-Podolsky-Rosen-Bohm
Gedankenexperiment: a new violation of Bell's inequalities. Phys. Rev. Lett.
48, 91–94.
Barbour, J. (1999). The End of Time: the Next
Revolution in our Understanding of the Universe. New York, NY: Oxford
University Press.
Bem, D. J. (2012). Feeling the future:
experimental evidence for anomalous retroactive influences on cognition and
affect. J. Pers. Soc. Psychol. 100, 407–425.
Bennett, C. H., and Wiesner, S. J. (1992).
Communication via 1- and 2-particle operators on Einstein-Podolsky-Rosen
states. Phys. Rev. Lett. 69, 2881–2884.
Bennett, M. V., and Zukin, R. S. (2004).
Electrical coupling and neuronal synchronization in the mammalian brain. Neuron
41, 495–511.
Bernroider, G., and Roy, S. (2005). Quantum
entanglement of K ions, multiple channel states and the role of noise in the
brain. Proc. SPIE 5841, 205–214.
Bierman, D. J., and Radin, D. I. (1997).
Anomalous anticipatory response on randomized future conditions. Percept. Mot.
Skills 84, 689–690.
Comments
Post a Comment